ভয়

৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ : বাবা বিহার এর এক প্রত্যন্ত গ্রামে কর্মরত। আমরা কলকাতায়। দেশ জুড়ে দাঙ্গা । কারফিউ। কি ভয়। মন প্রাণ দিয়ে প্রার্থনা করেছিলাম বাবাকে যেন ওরা মেরে না ফেলে। বাবা তো নিজের প্রাণের পরোয়া করেনা। অন্যায় দেখলেই রুখে দাঁড়াবে। বাবার যে চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে এত গর্ব, সেটাই সেদিন তাকে নিয়ে আশঙ্কার সব চেয়ে বড় কারণ হয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল আমার বাবাও যদি আরো পাঁচ জনের মত নিজের সুবিধা মত অন্যের তালে তাল মেলাতে পারত ! কি এমন ক্ষতি ছিল? অন্তত তার প্রাণের ভয় তো থাকত না ! উফ সে কি ভয় ! ভয় বোধহয় মেরুদন্ডের জোর ও কমিয়ে দেয়।

১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১ : কলেজ এ পড়ি। ক্যাম্পাস, চাকরি, নতুন জীবনের স্বপ্ন। সব ওলট পালট। স্বপ্নের দেশেও যে এই ভাবে এত মানুষকে এত সহজে মেরে ফেলা যায় আগে ভাবাও যায়নি। ঢুকে গেল আরো এক ভয়। ওই রূপকথার দেশ থেকেই তো আমাদের দেশে কাজ আসে, টাকা আসে, সঙ্গে আসে বাড়ি, গাড়ি, আরাম, আয়েশ, সুখ, শ্রীবৃদ্ধি। সাত সমুদ্দুর তের নদীর পারের ওই দেশটাতে তো মানুষ খুব সুখে শান্তিতে থাকে বলেই শুনেছিলাম। কত বন্ধু ভেবে রেখেছে এক বার কোনো রকমে ওই দেশে পাড়ি জমাতে পারলেই কেল্লা ফতে। সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। পড়তে বা চাকরি করতে গিয়ে প্রাণ হারানো, স্বজন হারানো, কাজ হারানো মানুষের গল্প শুনতে শুনতে কত রকম ভয় জাল বিছাতে লাগলো।

২৬ নভেম্বর, ২০০৮ : বরের মুম্বাই যাবার কথা ছিল সহকর্মীদের সঙ্গে। ভাগ্যিস ওর যাওয়া হয়নি। মুম্বাই এর রেল স্টেশনএ ওর সহকর্মীদের আটকা থাকা। খোঁজ খবর না পাওয়া। এদিকে খবর আসছে গোলাগুলির। মানুষ গুলো বেঁচে আছে তো? কি ভয়, কি ভয় ! লোকাল ট্রেন এ যাতায়াত করা সাধারণ মানুষ, চাকরি বা ব্যবসা করতে পথে বেরোনো মানুষ, পড়তে যাওয়া স্কুল কলেজ এর ছেলে মেয়ে সবাই সেই সকাল বেলায় স্নান খাওয়া সেরে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিল। অনেকে আর ফিরল না। কেউ কেউ ফিরল তবে এমন এক স্মৃতি নিয়ে যা বাকি জীবনটা তাদেরকে ভয়ে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। ছন্নছাড়া এই জীবনে চাকরি সূত্রেই এই শহর থেকে ওই শহরে যাওয়া, থাকা, দিন গুজরান। মুম্বাই শহরের হাতছানি এলেই ওই ভয়টা এসে তাড়া করে।

১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ : নির্ভয়া চলে গেল। রেখে গেল কি ভয়াবহ এক স্মৃতি। আজকাল রাতে ক্লান্ত শরীরে ফেরার সময় ফাঁকা বাস আর ফাঁকা সিট আর টানেনা। ভীষণ ভয় করে। অচেনা অজানা লোকের শরীর জরিপ করা চাউনি শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীতল স্রোত বইয়ে দেয়। অন্যায় দেখলেই রুখে দাঁড়ানোর সাহসটাও দিন দিন কেমন নিবে আসছে। পুরুষ বিদ্বেষ তো কোনো কালেই ছিল না। কিন্তু এখন আর অচেনা অজানা পুরুষ মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার কথা ভাবতেও পারি না। সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। আসলে ভীষণ ভয় করে। যদি লোকটা সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে? যদি আঁচড়ে কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করে দেয়?

১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪ : স্কুলএ ঢুকে ওরা শিশুদের মেরে ফেলল। নিজে এক সন্তানের মা হয়ে দেখলাম, শুনলাম, কত শিশু কত যন্ত্রণা সয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। তাদের বাবা মায়েদের বুক খালি করে। দেখলাম সন্তানহারা বাবা মায়ের কান্না, আর্তি। শিশুরাও নিরাপদ নয়। কেউ বা শিশুদের ওপর যৌন অত্যাচার করছে, কেউ বা প্রাণটাই কেড়ে নিচ্ছে। কি নিষ্ঠুর, কি নৃশংস। এই শিশুকে বড় করতেই, তার স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতেই আমরা বাবা মায়েরা ছুটে চলেছি। ওরা পেট ভরে খেয়ে পরে লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে, রোজগার করবে, সংসার করবে, পরিবার নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকবে। এই স্বপ্নের ইমারত গড়তেই এত বছরের এত প্রচেষ্টা, এত পরিশ্রম। ওদেরকেও কুঁড়িতেই ঝরে যেতে হচ্ছে, ফুল হয়ে ফোটার অনেক আগেই। আবার ভয়। শিশুটাকে সুস্থ ভাবে বড় করে তুলতে পারব তো? এত রকমের বিপদ থেকে আগলে রাখতে পারব তো?

আর কত দেখা বাকি আছে? আর কত রক্ত, কত প্রাণ, কত চোখের জল ওদের চাই? আরো কত দূর গেলে ওরা থামবে? আদৌ থামবে তো? ভয় হয় । বড় ভয়।