রান্নাঘর ও রাজ্যপাট

কিছুদিন যাবৎ চেষ্টা করছিলাম লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবন্টনের চিত্রটা বুঝতে।

যত পুরোনো হচ্ছি কাজের বাজারে তত দেখছি ওপরের দিকে মহিলাদের সংখ্যা কমতে থাকছে। কর্পোরেট সেক্টরে প্রায়শই সংখ্যা দিয়ে দেখানো হয় অনেক মেয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও মাঝপথে ছেড়ে যাচ্ছেন বা কোনো রকমে চাকরি বজায় রাখতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকছেন। নতুন কিছু করার চেষ্টা করছেন না বা বাড়তি দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। ফলে কর্মক্ষেত্রে তারা পিছিয়েই থাকছেন।

এদিকে মহিলারা কর্মক্ষেত্রে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। গত কয়েক বছরে যৌন হেনস্থা নিয়ে মহিলারা মুখ খোলায় চারিদিকে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ক্ষমতাবান পুরুষরা তাতে আতঙ্কিত হয়ে মহিলাদের প্রায় একঘরে করে দিতেও উঠে পড়ে লেগেছেন। প্রায় শাঁখের করাত অবস্থা।

মহিলা কর্মীদের ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। আমরা মহিলারা শুধু টাকার লোভে কদিন অন্তর চাকরি বদলাই না। আমরা পুরুষদের চেয়ে কম কর্মক্ষমও নই। স্থায়ী কর্মী হিসেবে মহিলাদের নিয়োগ সেক্ষেত্রে লাভজনক হবার কথা। আর কর্মীদের মধ্যে বৈচিত্র্য ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে যে কোনো বিষয়কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দেয়। তাই ইদানিং কর্মীদের মধ্যে বৈচিত্র্য বাড়াতে সংস্থাগুলিও মহিলাদের নিয়োগ বাড়াতে তৎপর হয়েছে।

কিন্তু মহিলাদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ দেবার জন্য নিয়ম কানুন বা ব্যবস্থাপনায় কিছু রদবদল ঘটানো প্রয়োজন। সংস্থা ব্যাপী বদল ঘটাতে গেলে যারা এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন, তাদের মধ্যে মহিলাদের থাকা প্রয়োজন। বা বলা ভালো নেতৃত্বে মহিলাদের জোরালো উপস্থিতি প্রয়োজন। কিন্তু ওপরের দিকে মহিলাদের সংখ্যা ভীষণ কম হওয়ায় এই কাজটা হচ্ছে না। ফলে বহু মহিলা ভুগছেন।

শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী যে ছবিটা পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে একই কাজের জন্য একই রকম কর্মক্ষম মহিলারা পুরুষদের চেয়ে কম পারিশ্রমিক পান। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয় যে মহিলারা নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে পা রাখতে চান না, বাড়তি দায়িত্ব নিতে চান না, বাড়তি সময় দিতে চান না, কোনো রকম ঝুঁকি নিতে চান না ইত্যাদি। মোদ্দা কথা হল কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হতে তেমন আগ্রহ দেখান না। আচ্ছা সত্যি কি তাই?

আমার ষোলো বছরের কর্মজীবনে আমি যা দেখছি তা খানিকটা আলাদা। বেশির ভাগ মহিলাকেই পেশার বাইরে এতো বেশি দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে হয় যে তারা আর পেরে ওঠেন না। আমি আমার নিজের ক্ষেত্রে দেখে আসছি গত দশ বছর ধরে আমার সঙ্গে একই প্রজেক্টে যারা কাজ করছেন তারা সবাই পুরুষ। তারা সবাই বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসেন। বাড়িতে থাকা মহিলারা তাদের খাবার গুছিয়ে দেন। সন্ধের পরেও দীর্ঘ সময় অফিসে থাকতে তারা তেমন দ্বিধাবোধ করেন না। অফিসের পরে তারা জিমে যান, কখনো খেলতে, খেতে বা মদ্যপান করতে যান। কারণ তাদের কাউকেই বাড়িতে কোনো কাজ করতে হয় না। রান্না বা শিশুদের দেখাশোনা ইত্যাদি সবটাই তাদের গৃহ কর্ম নিপুণা স্ত্রীরা সামলান। এদের সহকর্মী হিসেবে এদের সঙ্গে তাল মেলাতে আমি হিমশিম খেতে থাকি। সন্ধে বেলা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করি। কারণ আমায় বাড়িতে এসে রাঁধতে হয়, বাচ্চার লেখাপড়া দেখতে হয়।

আমার কিন্তু পুরুষ সহকর্মীদের চেয়ে নতুন কাজ শেখার বা করার আগ্রহ এতটুকু কম নয়। কিন্তু সব সময় মাথায় রাখতে হয় সংসার আর সন্তান সামলে তবেই কাজ করতে হবে। কর্মসূত্রে বেশ কিছু মেয়েকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তারা সবাই প্রায় আমার মতোই অতিরিক্ত পরিশ্রমে ক্ষয়ে যেতে যেতে নিজেদের স্বপ্ন গুলোকেই মেরে ফেলছে। প্রতিনিয়ত। দক্ষিণ ভারতে দীর্ঘদিন চাকরি করার সুবাদে দেখেছি নিচুতলার কর্মীদের প্রায় ৫০% মেয়ে। তারা যথেষ্ট শিক্ষিত, ভালো রোজগার করে, একাই একটা সংসার চালানোর ক্ষমতা রাখে। কিন্তু তার পরেও বাড়ির লোকের মন জোগাতে রাত থাকতে উঠে বাড়ির সব কাজ, রান্না নিজের হাতে সেরে তবে অফিসে আসে। তাই অফিসে একটু সেজেগুজেও আসতে পারে না। শুধু তাই নয়, এর পরেও পান থেকে চুন খসলে তাদের ওপর অত্যাচার হয়।

বিয়ের বাজারে এখনো পুরুষরা বড়লোক বাবার গৃহ কর্ম নিপুণা মেয়েকেই পছন্দ করেন। বিয়ের যৌতুক হিসেবে অনেক টাকা আর বিনা পারিশ্রমিকে খাটানোর মত বৌ পেলে ভালোই লাগার কথা। বৌ স্বনির্ভর হলে তার নিজস্ব মতামত থাকে। তাকে অত সহজে যা ইচ্ছে বোঝানো বা করানো যায় না যে।

নেহাত মন্দা আর মূল্যবৃদ্ধি ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, তাই আমরা কিছু মেয়েকে রোজগার করতে কাজে বেরোতে দেখছি। কিন্তু তাতেও কর্মক্ষেত্রে উন্নতিতে তাদের বাড়ির কেউ বিশেষ উৎসাহ দেন না। তার চেয়ে তাদের হাতের রান্নার সুখ্যাতি করেন। যে মহিলা সংসারে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন, তাতে বাড়ির স্বার্থপর পুরুষরা মহত্ত্বের শিরোপা দিয়ে অন্য মেয়েদের বোঝাতে চান, মেয়েদের ঠিক এই রকম হওয়া উচিত।

তাতে যদি আমার মত সমাজের সব নিয়ম কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো মহিলার সামনে পড়তে হয়, আঁতে কিঞ্চিৎ ঘা লাগে বইকি। আমার কিছু সহকর্মী আমায় সোজাসুজি বলেছেন, আমি ভারী পুরুষালি। তাই আমার বিয়ে যে টেঁকেনি, সেটাই স্বাভাবিক। অবশ্য আমার বিয়েটা টিঁকে গেলে আমিই হয়তো আর টিঁকতাম না। শুধু তাই নয়, প্রায়শই আমার সামনে তারা আলোচনা করেন, কেন মেয়েদের বাড়িতে থাকা ভাল ইত্যাদি। সুখী সংসারী মহিলারাও আমায় কিছু কম কথা শোনাননি। ঘরে ও বাইরে। কিন্তু এত কিছুর পরেও এই জীবনটা বেছে নেবার জন্য আফসোস হয়নি কখনো। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়,

“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব-শৃঙ্খল কে পড়িবে পায় হে, কে পড়িবে পায়?”

বেশ কিছু মহিলাকেও দেখি বিষয়টাকে এই ভাবেই আত্মস্থ করে নিয়েছেন। তারা স্বামীকে ঘরের কাজ করতে দিতে চান না, রাঁধতে দিতে চান না, কারণ পুরুষরা নাকি ভালভাবে এই কাজ গুলো পারেন না। যারা পারেন না, তারা করতে করতে শিখে নেবেন। আমরা শিখতে পেরেছি, তারা পারবেন না কেন? আবার কিছু মহিলা নিজেরাই বাড়ির বাইরে রোজগার করতে যেতে চান না। মূলত তিনটি কারণে | ১. স্বামীর রোজগারে বাড়ির কাজ করানোর জন্য তিনি লোক রাখতে পারেন, তাই বাড়িতে থেকে আরাম আয়েশ করতে পারেন। ২. ঘরে আর বাইরে দুই শিফটে কাজ করাটা তারা পেরে ওঠেন না। ৩. আর কিছু মহিলা আছেন যারা সম্ভবত আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন ।

পুরুষতন্ত্রে পুরুষ তার ক্ষমতা আর সুবিধার জায়গা এত সহজে ছেড়ে দেবে এমন আশা আমরা করি না। কিন্তু মেয়েরা? তারা তো ভুক্তভোগী। তারা কবে বুঝবেন? কবে গৃহশ্রমের সমবন্টনের জন্য আওয়াজ তুলবেন? আমরা চাইলেই হবে। আস্তে আস্তে হলেও হবে। তবু হবে। অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেয়েদের আমাদের মত এত কষ্ট করতে হবে না।

তথ্য সূত্র:

https://www.payscale.com/data/gender-pay-gap

https://www.ilo.org/asia/media-centre/news/WCMS_633284/lang–en/index.htm

https://www.washingtonpost.com/posteverything/wp/2017/04/05/why-would-millennial-men-prefer-stay-at-home-wives-race-and-feminism/?noredirect=on&utm_term=.d95f51aa5a28

https://www.cnbc.com/2018/04/10/heres-what-women-could-earn-if-household-chores-were-compensated.html

Leave a comment