দৃষ্টিকোণ

দৃষ্টিকোণ – এ এক ভারী মজার শব্দ। এই ছোট্ট শব্দটাই একটি ঘটনার রঙ আমূল বদলে দিতে পারে। বুঝলেন না তো? দাঁড়ান, বোঝাই তবে…

ইতিহাস বইতে পড়া ক্ষুদিরাম বসু বা বিনয় – বাদল – দীনেশকে  মনে পড়ে? অল্প বয়েসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের প্রাণ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। আমাদের দেশ তখন বহিরাগত শাসকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। শাসিত বা বলা ভালো শোষিত ভারতবাসীর কাছে তাঁরা তখন বিপ্লবী। তাঁদের নামে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।  আবার সেই একই মানুষ গুলি শাসক ইংরেজের চোখে তখন দেশদ্রোহী।  ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদী। শুধু দৃষ্টিকোণ টুকু বদলে নিয়ে দেখলেই মানুষ গুলোর রঙ বদলে যায়।

একই ভাবে সুখ দুঃখ সবই দৃষ্টিকোণের সঙ্গে সঙ্গে রঙ বদলায়। এবার কয়েকটা গল্প বলি…

একটি মেয়ের ভারী দুঃখ। তার দিদির চেয়ে তাকে অনেক বেশি সুন্দর দেখতে। বিদ্যা বুদ্ধিতেও সে দিদিকে দিব্যি ছাপিয়ে যায়। এ হেন দিদির বিয়ে হলো একজন ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তার নিজের বিয়ে হলো তারই ছোটবেলার বন্ধু ও প্রেমিক এক চাকুরিজীবি ইঞ্জিনিয়ার এর সঙ্গে। দিদির নিজের মস্ত বড় বাড়ি, নিজেদের ছোট ভাড়া বাড়ির দু খানা কামরা জুড়ে সংসার। দিদির বাড়িতে কত দামী দামী আসবাব, নিজের বাড়ির গুলো একদমই সস্তা। দিদির বর বারো মাসে তের পার্বনে  দিদিকে ও বাড়ির সকলকে অনেক দামী জিনিস উপহার দেয় কিন্তু নিজের স্বামী পেরে ওঠে না।সবার কাছে তাকে ছোট হতে হয়। অথচ সে তার দুঃখের কথা কাউকে বললে সবাই বলে, আরে এত দুঃখের কি আছে? কি সুন্দর ভালো মানুষ বর, ভালো চাকরি, গোছানো সংসার!

এবার আর একটি মেয়ের গল্প বলি! সেও ভারী সুন্দর দেখতে, লেখাপড়ায় তুখোর, নিজের উপার্জনে জীবনের অনেক আরাম আয়েশ কেনার ক্ষমতা রাখে! তার বর ও রূপে গুনে তার সমকক্ষ। এক সময়ের সহপাঠি ও পরে প্রেমিক। এই মেয়েটিরও মনে ভারী দুঃখ। বরের সঙ্গে মতের বা বলা ভালো মনের মিল কমতে থাকে দিন দিন। ছোট ছোট চির খেতে খেতে সম্পর্কের ফাটলটা দিন দিন বেড়ে চলে। বর তার বাবা বা দাদার মত তো নয়ই, এমন কি ভালো পুরুষ বন্ধুদের মত ও নয়। কত স্বপ্ন ছিল এক ঝকঝকে পুরুষ ঝরঝরে ইংরেজিতে কথা বলবে, ছোট খাটো ভালো লাগা, খারাপ লাগার খেয়াল রাখবে, রেখায় লেখায় স্ত্রীর প্রতিভার বিকাশে পাশে থাকবে, গর্ব বোধ করবে ! কিন্তু সে আর হলো কই? রোজনামচার জীবনে হারিয়ে গেছে আঁকার ক্যানভাস, লেখালিখির খাতা। চার পাশের বাকি মানুষেরা এদের জীবনে দুঃখের কারণই খুঁজে পায় না। দিব্যি সানন্দার পাতার ছবির মত সাজানো সংসার।

এ তো গেল সংসারী মেয়েদের গল্প। এবার বলি এক একা মেয়ের গল্প। সে একেবারেই সংসারী ছিল না। যথারীতি ইস্কুল কলেজ আপিস তাকে কাজের জন্য অনেক নম্বর দিলেও সংসার দিয়েছে শুন্য। বছরের পর বছর শুন্য পেলে কি আর ইস্কুল কলেজ বা আপিস মেনে নেয়? সংসারই বা নেবে কেন? ক বছর পরেই হাতে এলো টি. সি. (আহা ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নয়, ডিভোর্স এর ডিক্রী !)। উড়ন চন্ডী মেয়ে সংসারের খাঁচা থেকে মুক্তি পেল। এবার তাহলে তার ভারী সুখের সময় ! মনের মত একটি চাকরি, একটি ছোট্ট আস্তানা, এক পাল দামাল বন্ধু আর অনেকটা স্বাধীনতা। আবার নতুন করে লেখালিখি, গান বাজনা, নাটক, বেড়ানো কত সুযোগ। আবার কি চাই? আরে বাপু চাওয়ার কি কোনো শেষ আছে? এই পাখির মত উড়তে চাওয়া মেয়েটিরও আজকাল ওই সংসার নামক খাঁচাটির দিকে ভারী লোভ ! তারও অমনি একটি বর চাই, ঘর চাই, আদর চাই, সোহাগ চাই!

ভেবে দেখলাম আমাদের সবার কিছু না কিছু দুঃখ আছে।যার যা নেই, তাই নিয়েই দুঃখ। অথচ যার যা আছে, তা নিয়ে সুখ নেই। শুধুই দৃষ্টিকোণের তফাত। ওইটুকু একটু বদলে নিলেই দুঃখ গুলো সুখ হয়ে যেতে পারত। আচ্ছা, বিষয়টা কি তবে এতই সহজ? আমরা কি তবে ইচ্ছে করেই ভেবে দেখছি না আর কষ্ট পেয়ে চলেছি? না, তাও ঠিক নয়। আসলে আমার যেটুকু আছে সেইটুকুতেই আটকে গেলে এগিয়ে যাবার ইচ্ছেটাই তো থমকে যেত। নতুন নতুন পথের খোঁজ আর সেই পথে এগিয়ে চলার নামই তো জীবন।

আমার মত যারা মনের অসুখে ভোগে, মাঝে মধ্যেই তারা এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে, আর সেই পথটার শেষ খুঁজতে থাকে। কারণ সেই পথের শেষেই আছে আলো। আমিও খুঁজি আমার আলো… এই খুঁজতে খুঁজতেই পেয়েছি এক চিলতে রুপোলি রেখা। ওই যে মনের বন্ধ কুঠুরীর মধ্যে জমে থাকা অনেক স্বপ্ন, যেগুলো পূর্ণ না হবার জন্যই এত যন্ত্রণা…  তার মধ্যেই বেশ কয়েকটা আছে এক্কেবারে নিজের হাতের তালুর মধ্যে। যাকে চাইলেই বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়। আর বাকি গুলো সব জালের মত ছড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে অন্য অনেকের সঙ্গে। নিজের হাতেরটুকু নিজের কাছে রেখে বাকিটুকু ঝেড়ে ফেলে দিতে পারলেই চাওয়া পাওয়ার হিসেব মিলিয়ে দেওয়া যায়। একবার দৃষ্টিকোণটা বদলে দেখলে হয়না? চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি? কি বলেন?

One thought on “দৃষ্টিকোণ

Leave a comment