মায়ের কাজ

আমি একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত স্বনির্ভর মহিলা। অন্য পরিচয় আমি একজন স্কুল পড়ুয়া শিশুর মা। রাজনীতিতে আগ্রহ থাকলেও সক্রিয়ভাবে কখনো কিছু করে ওঠা হয়নি। তবে বামপন্থী বাড়িতে বড় হবার সুবাদে শ্রেণী সংগ্রাম শব্দবন্ধটির সঙ্গে বেশ পরিচিত। যত বয়স বাড়ছে তত বেশি করে রাজনীতির গুরুত্ব বুঝতে পারছি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার শ্রেণীর মানুষজনের মধ্যে কাজকর্ম, সুযোগ সুবিধা, সমস্যা ও সমাধান নিয়ে সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই দুচার কথা লিখতে বসা।

আমাদের দেশে মেয়েদের বড় করা হয় শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর জন্য। না, শহুরে শিক্ষিত পরিবারের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের অন্যথা বিশেষ হয় না। ছোট থেকেই দেখেছি পরিবারের ঘেরাটোপে আমরা সবচেয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করি। আমার মা চাকরি করতেন না, বাবা সাধারণ চাকরি করতেন আর এতো বেশি আর্থিক দায়দায়িত্ব সামলাতেন যে ছোটবেলাটা আমাদের বেশ অনটনে কেটেছে। মা ঘর আর সন্তান সামলাতেন। পরিবারকে একটি একক ভাবলে আর্থিক আর সাংসারিক দায়ভার ভাগ করে নেবার এই বন্দোবস্তকে আপাতদৃষ্টিতে খারাপ মনে হয়না।

নিশ্চিন্তির এই জীবন হঠাৎ একটি দুর্ঘটনায় এলোমেলো হয়ে গেল আর আমিও এক লাফে অনেকটা বড় হয়ে গেলাম। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। বাবার অফিসে গোলমাল। ইউনিয়নের সঙ্গে মালিকপক্ষের মামলা চলছিল। সেই মামলায় ব্যাংক কর্মীরা হেরে গেলেন। বাবা বদলি হয়ে গেলেন বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সে সময় আমার মা অন্তঃসত্ত্বা। তাতে আমাদের বাড়িতে আমার আর মায়ের পক্স হয়েছিল। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে অসুস্থ মা আর আমাদের ফেলে বাবাকে বিহারে চলে যেতে হল চাকরি বাঁচাতে। বাবা বরাবর পেটের অসুখে ভুগতেন। তাই তাঁর খাওয়া দাওয়ায় অনেক বিধিনিষেধ ছিল। কিন্তু যেখানে বদলি হয়ে গেলেন, সেখানে যা পেতেন তা প্রায় সবই তাঁর খাওয়া বারণ ছিল। এক সময় সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সহকর্মী সঙ্গে করে বাড়িতে দিয়ে গেলেন। সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। নিজের হাতে জলের গ্লাসও ধরে খেতে পারতেন না। এদিকে ছুটি শেষ। মাইনে বন্ধ হয়ে গেল। আমরা অথৈ জলে পড়লাম। বাবার ডাক্তার মাকে বললেন, লোকটাকে আবার ফেরত পাঠালে মরে যাবে, আপনি কি কিছু একটু করতে পারেন না? মা বাবার অফিসে, আত্মীয় স্বজনের দরজায় দরজায় ঘুরল। কিছুই সুরাহা হল না। শেষমেশ বাবার ডাক্তার ব্যাংকের চেয়ারমানকে চেনার সুবাদে অনুরোধ করে বাবার কলকাতায় বদলির ব্যবস্থা করেন। আমাদের পরিবার কোনমতে বেঁচে যায়।

এই ঘটনাটা আমাদেরকে অনেকটা বদলে দিয়েছিল। ভাল ছাত্রী, নিজের ভাল লাগা বিষয়ে কিছু করতে চাই বলে নয়, আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হতেই আমাদের তৈরী করা হয়। যাতে মায়ের মত অবস্থায় আমায় পড়তে না হয়। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরেই বিয়ের কথা ভাবা হয়। এই অবধি গল্পটা আমার জন্য মন্দ ছিল না।

আমাদের দেশে মাতৃত্ব একটু বেশি মাত্রায় গৌরবান্বিত। সন্তানের জন্ম দেওয়া এক অতি স্বাভাবিক কাজ। তাতে যে কি করে আমরা এতো মহৎ হয়ে যাই কে জানে। সন্তানের জন্মের পর মা বাড়ির বাইরে কাজে গেলে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারে, যেখানে বাবার আর্থিক সঙ্গতি আছে, ভীষণ ভাবে সমালোচিত হন। অনেকেই মনে করেন কর্মরতা মায়েরা সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। তাই সন্তান অবহেলিত হয়।

আমার নিজের গল্পটা একটু অন্যরকম। গৃহ হিংসার কারণে দীর্ঘ ৬ বছরের বিয়ে ভেঙে আমি বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। আত্মসম্মানের কারণেই প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে একটি কপর্দকও নিয়ে আসিনি। আমার ক্ষেত্রেও সন্তানের মুখ চেয়ে এই সম্পর্কটিকে বজায় রাখতেই আমায় সবাই উপদেশ দিয়েছিল। অথচ আমার ৩ বছরের ছেলের মানসিক অবসাদ ধরা পড়ায় নামজাদা ডাক্তাররা আমায় অবিলম্বে বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসতে পরামর্শ দেন। ভেবে দেখুন, সন্তানের ভাল বলতে আমরা যা জেনে এসেছি তার অনেক কিছুই কিন্তু ভুল। একলা মায়ের সঙ্গে থেকে আমার সন্তান এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।

না আমার গল্পটা খুব একটা বিচ্ছিন্ন গল্প কিন্তু নয়। আমাদের দেশে বহু মা আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর নন বলে সন্তানকে নিয়ে গৃহ হিংসার অসুস্থ পরিবেশে পড়ে থাকতে বাধ্য হন। সন্তানের ওপর সেই পরিবেশের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সন্তানের কাছে এর মানেটা দাঁড়ায়, যে কোনো মূল্যে বিয়ে বা পরিবার বাঁচিয়ে রাখাটা জরুরি। কাল যদি সন্তানের জীবনেও এরকম একটি অঘটন ঘটে, সে বেরিয়ে আসার সাহস পাবে কোথা থেকে? একজন স্বনির্ভর মা সে সাহস জোগাতে পারেন। নিজের জীবন দিয়ে।

একলা মায়ের ক্ষেত্রে নাহয় আর্থিক স্বনির্ভরতা একান্তই জরুরি। তাহলে কি স্বামী স্ত্রী এক সঙ্গে থাকলে সন্তানের মায়ের রোজগার করতে যাবার প্রয়োজন নেই ? অবশ্যই আছে। আজকের দিনে বেশির ভাগ মানুষ বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। অর্থাৎ রোজগার সম্পূর্ণ ভাবে বাজার নির্ভর। যে যোগ্যতার মাপকাঠিতে আজ আমরা ভাল চাকরি করছি, কাল হয়তো সেই যোগ্যতা বাজারে মূল্যহীন হয়ে পড়তে পারে। নিয়মিত খবরের কাগজে চোখ রাখলেই দেখবেন, মন্দা আর মূল্যবৃদ্ধিতে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠছে। বাজারের সঙ্গে তাল রাখতেই পরিবারে একাধিক রোজগেরে মানুষ থাকলে সুবিধে।

এবার আসি মহিলাদের কাজের গুরুত্ব প্রসঙ্গে। আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারে শাশুড়ি বৌয়ের টানাপোড়েন অতি পরিচিত ছবি। সংসারের চাবির দখল নিয়ে এই যে লড়াই, তার কারণ মূলত মহিলাদের নিজস্ব একটি পরিচিতির অভাব। আমরা সবাই অমুকের মেয়ে, অমুকের বৌ, অমুকের মা হয়ে থাকতে অভ্যস্ত। আমরা সবাই কিছু না কিছু পারি। আমরাও কিন্তু রাঁধুনি, শিল্পী, শিক্ষিকা, ব্যবসায়ী কোন না কোন পরিচিতি পেতেই পারতাম। ঘর চালাতেও আমরা মহিলারা দিব্যি জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ শিখে নিই। নিজের উপার্জন থাকলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, সঙ্গে আয় ব্যয় সঞ্চয়ের হিসেব নিকেশ আয়ত্তে আসে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা বাড়ে। যেহেতু আমাদের মেয়েদের দীর্ঘদিন ধরে পুরুষতন্ত্রের যাঁতাকলে মগজ ধোলাই হয়েছে, তাই বাইরের পৃথিবীটা নিজেদের চোখে সরেজমিনে দেখে নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। নইলে মেয়ে বলে আমাদের যা যা করতে হয় বা করতে নেই, তার কোনটা কতটা যুক্তিসঙ্গত আদৌ জানা যাবে না।

এবার আসি সন্তানের প্রসঙ্গে। কর্মরতা মায়েরা সন্তানকে সারা দিন সময় দিতে পারেন না এটা ঠিকই। কিন্তু তাতে সন্তানকে অবহেলা করা হয় কিনা দেখতে হবে। বাড়িতে থাকলেই সন্তানকে ভাল করে মানুষ করা যায় কি? আমার মা বাড়িতে থাকতেন, কিন্তু সমসাময়িক বিষয়ে অভিজ্ঞতা না থাকায় আমায় সেভাবে তৈরী করতেই পারেননি। বাজার থেকে গেরস্থালি, ব্যাংকের কাজ থেকে অন্যান্য অফিসের কাজ, যৌন হেনস্থা থেকে গৃহ হিংসা কোন বিষয়টা কি ভাবে সামলাতে হয় আমায় শেখাতে পারেননি। অথচ এর একটাও না জানলে আমাদের চলে না।

আমার সন্তান কর্মরতা মায়ের কাছে বড় হচ্ছে। কাজ সেরে বাড়ি ফিরলে যে মা ক্ষুধার্ত ক্লান্ত থাকে, মুখের কাছে এক গ্লাস জল এনে দিলে শান্তি পায় এই বোধটুকু তার শৈশবেই তৈরী হয়ে গেছে। অথচ আমাদের বাড়িতে থাকা মায়েদের ক্ষেত্রে আমরা এইটুকুই বুঝতে অনেক সময় নিয়েছি। আশা রাখি ভবিষ্যতে আমার সন্তানের কর্মরতা স্ত্রী বাড়ি ফিরলেও আমার সন্তান একই ভাবে তার পাশে থাকবে। খরচ আর পরিশ্রম, দুটো বিষয়েই চাকুরিরতা মায়ের সন্তানেরা অনেক বেশি ওয়াকিফহাল। আমাদের সব যুদ্ধ তো ওদের জন্যই। সেই যুদ্ধে ওরা যদি ছোট থেকেই আমাদের পাশে থাকে, তাতে বোঝাপড়া মজবুত হয়। নিজেদের কাজ নিজেরা করতে শেখাও ভবিষ্যতে স্বনির্ভর হতে যথেষ্ট সাহায্য করে। ঘরে থাকা মায়েদের আদর যত্নে আমরা অনেকেই সময়মতো সেসব শিখিনি।

আমাদের মত কর্মরতা মায়েদের সন্তানেরা হয়তো নিত্য ভাল মন্দ রান্না খেতে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু পুষ্টির জন্য আদৌ সেসব জরুরি কি? তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি বিষয়ে চাকুরিরতা মা তাকে সাহায্য করতে পারেন। আমাদের মত মায়েদের নিজেদের একটি জগৎ থাকায় সন্তানের জগতে বেশি জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তাতে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে সহাবস্থান সুবিধাজনক হয়।

পরিসংখ্যানের বিচারেও আমার পরিচিত মহলে দেখি কর্মরতা মায়ের সন্তানেরা জীবনযুদ্ধে যথেষ্ট সফল। লিঙ্গ রাজনীতির দিক দিয়ে দেখলেও কর্মরতা মায়ের সন্তানেরা মহিলাদের সম্পর্কে অনেক বেশি সংবেদনশীল হন। দেশের গৃহ আর যৌন হিংসার সংখ্যার নিরিখে এই বিষয়টার গুরুত্ব অপরিসীম। মনে রাখতে হবে আজ দেশে যত পুরুষ মহিলা ও শিশুদের ওপর অত্যাচারের দায়ে দোষী, তারা সবাই কোন না কোন মায়ের সন্তান, মায়ের আদর যত্নে বড় হয়েছেন। এই মানসিকতা বদলাতে হলে আগে মায়েদের মনের প্রসার প্রয়োজন।

সব মিলিয়ে বলতে পারি যত মেয়ে রোজগার করে স্বনির্ভর হবেন, তত সমাজ উপকৃত হবে। মহৎ মাতৃত্বের মেকি মুকুটটি আসলে পুরুষতন্ত্রের একটি চালাকি মাত্র। মহিলারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন তত ভাল।

Leave a comment